Excerpt: প্লাস্টিক খাওয়া মাশরুম — প্রকৃতির এক অলৌকিক বিপ্লব! জানুন কীভাবে এই ছোট্ট জীব প্লাস্টিকের সংকট কাটাচ্ছে এবং পৃথিবীকে ফিরিয়ে দিচ্ছে শান্তির পথে।
প্লাস্টিক খাওয়া মাশরুম: ১টি অলৌকিক বিপ্লব! (Plastic-Eating Mushroom)

আপনি কি জানেন, পৃথিবীতে গাছ আসার আগেই ছিল বিশাল মাশরুম? হ্যাঁ, প্রায় ১০০ কোটি বছর আগে! আর আজ, সেই একই মাশরুম আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা—প্লাস্টিকের ভরাট পৃথিবী—কে সমাধান করতে ফিরে এসেছে। আমাজনের ঘন জঙ্গলে পাওয়া এক অদ্ভুত ছত্রাক, যার নাম প্লাস্টিক খাওয়া মাশরুম (Plastic-Eating Mushroom), তা শুধু বিজ্ঞানের গল্প নয়, এটি আধ্যাত্মিক প্রতীকও বটে—যেন প্রকৃতি নিজেই আমাদের ভুলের শোধ নিচ্ছে, কিন্তু ক্ষমার সঙ্গে।
এই মাশরুম শুধু প্লাস্টিক খায় না, তা থেকে তৈরি করে মিষ্টি স্বাদের কাপ, পোশাক, এমনকি বাড়ির আসবাবও! চলুন, একটু গভীরে যাই—প্রকৃতির এই নিঃশব্দ যোদ্ধার গল্পে।
প্লাস্টিক খাওয়া মাশরুম: কীভাবে শুরু হলো এই যাত্রা?
২০১১ সাল। ইকুয়েডরের আমাজন বনে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র গবেষণায় নেমেছিলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল নতুন প্রজাতির ছত্রাক খুঁজে পাওয়া। কিন্তু যা পেলেন, তা ছিল চমকপ্রদ: পেস্টালোটিওপসিস মাইক্রোস্পোরা (Pestalotiopsis microspora)—এক ধরনের মাশরুম যা প্লাস্টিককে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে!
আরও অবাক করা বিষয়? এটি অক্সিজেনহীন পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে। মানে, ল্যান্ডফিলের গভীরে, যেখানে অক্সিজেন নেই, সেখানেও এটি কাজ করবে। এটি শুধু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নয়, এটি প্রকৃতির এক অলৌকিক উত্তর—যেন পৃথিবী বলছে, “তোমরা যা ভেঙেছ, আমি তা ঠিক করব।”
আর হ্যাঁ, এটি খেতেও নিরাপদ—মানে এটি মানুষের জন্য বিষাক্ত নয়। কী অদ্ভুত নয় কি? যে জিনিসটা আমরা ফেলে দিচ্ছি, সেটাই আমাদের বাঁচাবে।
প্লাস্টিক খাওয়া মাশরুম কীভাবে কাজ করে?
এখানেই আসে অস্ট্রিয়ার ডিজাইনার ক্যাথরিনা আঙার (Katharina Unger) এবং হল্যান্ডের বিজ্ঞানীদের অবদান। তাঁরা তৈরি করেন “ফানজি মিউটারিয়াম” (Fungi Mutarium)—একটি ছোট্ট ল্যাব-স্টাইল ডিভাইস যেখানে মাশরুমকে প্রথমে আগার জেলি, চিনি ও স্টার্চ দিয়ে পুষ্ট করা হয়। তারপর তাতে প্লাস্টিকের টুকরো ঢোকানো হয়।

কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যে, মাশরুম প্লাস্টিককে হজম করে ফেলে এবং তৈরি করে একটি মিষ্টি স্বাদের, খাদ্যযোগ্য “কাপ”! হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন—প্লাস্টিক থেকে তৈরি কাপ যা খাওয়া যায়!
এই প্রক্রিয়া শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, এটি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি আমাদের শেখাচ্ছে যে কোনো কিছুই নষ্ট হয় না—শুধু রূপ বদলায়। প্লাস্টিক যে শুধু আবর্জনা নয়, তা পরিবর্তিত হয়ে জীবনের অংশ হতে পারে।
ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে বাড়িতে ছোট রিসাইক্লিং ইউনিট হিসেবে, অথবা শহরের বড় রিসাইক্লিং প্ল্যান্টে। কল্পনা করুন, আপনার রান্নাঘরে একটি বাক্স—যেখানে প্লাস্টিকের বোতল ঢুকিয়ে দিলে কয়েক সপ্তাহ পর পাবেন একটি মাশরুম-কাপ!
মাশরুমের মূল: পৃথিবীর নিচে লুকানো নেটওয়ার্ক
মাশরুমের যে অংশটি আমরা দেখি, তা শুধু বরফের ডগা। আসল জাদু ঘটে মাটির নিচে—যেখানে ছড়িয়ে আছে মাইসেলিয়াম (Mycelium)। এটি মাশরুমের মূল নেটওয়ার্ক, যা কিলোমিটার পর কিলোমিটার জুড়ে থাকে।
আমেরিকার ওরেগনে পাওয়া গেছে একটি মধু মাশরুমের মাইসেলিয়াম যা ৮.৮ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে আছে—এবং এর বয়স প্রায় ২,৪০০ বছর! শরৎকালে এটি হলুদ মাশরুম ফুটিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে।
আরও আশ্চর্যের বিষয়? পৃথিবীর ৯০% গাছ এই মাইসেলিয়ামের সঙ্গে যুক্ত। এটি গাছের শিকড়ের মতো কাজ করে—পানি, খনিজ, খাদ্য এক গাছ থেকে অন্য গাছে পাঠায়। বিজ্ঞানীরা একে বলেন “উড ওয়াইড ওয়েব” (Wood Wide Web)—প্রকৃতির নিজস্ব ইন্টারনেট!
এই নেটওয়ার্ক শুধু খাদ্য বিনিময় করে না, এটি গাছগুলোকে সতর্কও করে—যেমন কোনো পোকা বা রোগ আসলে। এটি দার্শনিক দৃষ্টিতেও গভীর: প্রকৃতি কখনও একা থাকে না, সবকিছু পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত।
প্লাস্টিকের বদলে মাশরুম: ভবিষ্যতের উপকরণ
১৯৬৭ সালের চলচ্চিত্র “দ্য গ্র্যাজুয়েট”-এ এক চরিত্র বলেছিলেন, “প্লাস্টিকে ভবিষ্যৎ আছে।” কিন্তু আজ, ভবিষ্যৎ হয়তো প্লাস্টিকের বদলে মাশরুমে!
২০২১ সালে ফ্যাশন ডিজাইনার স্টেলা ম্যাকার্টনি মাইসেলিয়াম থেকে তৈরি করেন কালো ‘লেদার’ পোশাক। এডিডাস, লুলুলেমন, হারমেস—সবাই এখন মাশরুম-ভিত্তিক উপকরণ ব্যবহার করছে। কারণ? এটি পরিবেশবান্ধব, পচনশীল, এবং প্রাণী নির্যাতনমুক্ত।
সিয়াটলে, ইবেন বায়ার ও গ্যাভিন ম্যাকিনটায়র তৈরি করেছেন “গ্রিনসুলেট”—মাশরুম দিয়ে তৈরি আগুন প্রতিরোধী উপকরণ। তাঁদের কোম্পানি “ইভোকেটিভ ডিজাইন” এখন “বেকন” নামে মাইসেলিয়াম বেসড পণ্য তৈরি করছে—যা মাংসের বদলে ব্যবহার করা যায়!
এটি শুধু প্রযুক্তি নয়, এটি এক ধরনের আত্মিক পরিবর্তন—যেখানে মানুষ প্রকৃতির কাছে ফিরছে, তার নিয়ম মেনে চলছে, তার উপকরণ ব্যবহার করছে।
মাশরুম: কীটনাশক থেকে তেল পরিশোধন পর্যন্ত
মাশরুমের ক্ষমতা শুধু প্লাস্টিকে সীমিত নয়। ২০১৫ সালে আইরিশ বোটানিস্ট ব্রায়ান মারফি দেখান, এন্ডোফাইট (Endophyte) মাশরুম গাছকে রোগ থেকে রক্ষা করে—এটি কীটনাশকের প্রাকৃতিক বিকল্প।
আর পল স্ট্যামেটস (Paul Stamets)—যিনি নিজেকে “বনচৌকি” বলেন—তিনি মাশরুম ব্যবহার করেন তেল ও রেডিয়োঅ্যাক্টিভ বর্জ্য ভাঙতে। তাঁর মতে, মাইসেলিয়াম হলো পৃথিবীর “প্রাকৃতিক ইমিউন সিস্টেম”—যা দূষণকে শোষণ করে, রূপান্তর করে, পুনরুজ্জীবিত করে।
এখানে বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি মিলে যায়: প্রকৃতি নিজেই নিজেকে সারিয়ে তোলে। আমাদের কাজ শুধু তাকে বাধা না দেওয়া, বরং সাহায্য করা।
ইকুয়েডর ও মাশরুম: প্রকৃতির প্রতিশোধ নয়, উপহার
ইকুয়েডর—যে দেশ তেলের লোভে নিজের বন কেটে ফেলেছে, যেখানে টেক্সাকো কোম্পানি পরিবেশকে ধ্বংস করেছে, যেখানে দারিদ্র্য ও উন্নয়নের দ্বন্দ্ব চলছে—ঠিক সেখানেই পাওয়া গেল প্লাস্টিক খাওয়া মাশরুম!
২০০৭ সালে রাষ্ট্রপতি রাফায়েল কোরিয়া বিশ্বকে অর্থ চেয়েছিলেন বন রক্ষার জন্য—কিন্তু কেউ সাড়া দেননি। আজ, সেই একই বন আমাদের দিচ্ছে এক অদ্ভুত উপহার—যা শুধু ইকুয়েডরকে নয়, গোটা পৃথিবীকে বাঁচাতে পারে।
এটি কোনো প্রতিশোধ নয়। এটি প্রকৃতির করুণা। যেমন এক ঋষি বলেছিলেন, “প্রকৃতি কখনও শাস্তি দেয় না, সে শুধু ফল দেয়।” আমরা যা বপন করি, তাই ফলায়। আজ আমরা প্লাস্টিক বপন করেছি—আর প্রকৃতি তা থেকে মাশরুম ফলিয়ে দিচ্ছে।
আপনি কী করতে পারেন?
প্রথমত, প্লাস্টিক কম ব্যবহার করুন। দ্বিতীয়ত, মাশরুম-ভিত্তিক পণ্য সমর্থন করুন। তৃতীয়ত, এই গল্পটি শেয়ার করুন—যাতে আরও মানুষ জানতে পারে যে সমাধান আছে, আশা আছে।
ভবিষ্যতে হয়তো আপনার বাড়িতে থাকবে একটি মাশরুম বক্স—যেখানে প্লাস্টিক ফেললে বের হবে খাদ্য বা জিনিসপত্র। স্বপ্ন মনে হলেও, বিজ্ঞান আজ তাই বলছে।
আপনার অভিজ্ঞতা কমেন্টে জানান: আপনি কি কখনও মাশরুম দিয়ে তৈরি পণ্য ব্যবহার করেছেন? নাকি প্লাস্টিক কমানোর চেষ্টা করছেন? আপনার গল্প শুনতে চাই!
এবং যদি প্রকৃতি ও বিজ্ঞান নিয়ে আরও গল্প পড়তে চান, তাহলে আমাদের প্রকৃতি ও বিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে ঘুরে আসুন।
বাইরের জগতের জন্য পড়ুন: National Geographic-এর এই গবেষণা প্লাস্টিক খাওয়া মাশরুম নিয়ে আরও তথ্য দেয়।
প্লাস্টিক খাওয়া মাশরুম (Plastic-Eating Mushroom) কি পুষ্টিকর?
গবেষণা বলছে, পেস্টালোটিওপসিস মাশরুম শুধু প্লাস্টিক ভাঙে না, এটি খাদ্যযোগ্যও — যার মধ্যে আছে প্রোটিন, ফাইবার ও প্রাকৃতিক এনজাইম। যদিও এখনও ব্যাপক পুষ্টিগুণ নিয়ে গবেষণা চলছে, কিন্তু প্রাথমিক ফলাফল আশাব্যঞ্জক। প্রকৃতি আবারও প্রমাণ করছে — সমাধান সবসময় তার কোলেই লুকিয়ে থাকে।
FAQ Schema (ঐচ্ছিক)
Q: প্লাস্টিক খাওয়া মাশরুম কি মানুষের জন্য ক্ষতিকর?
A: না, গবেষণা বলছে এটি খাদ্যযোগ্য এবং নিরাপদ।
Q: কোথায় প্লাস্টিক খাওয়া মাশরুম পাওয়া গেছে?
A: ইকুয়েডরের আমাজন বনে, ২০১১ সালে।
Q: এটি কি বাড়িতে ব্যবহার করা যাবে?
A: ভবিষ্যতে হ্যাঁ—ছোট ডিভাইস তৈরির প্রচেষ্টা চলছে।


